রাত ২টা ২৭মিনিট ।
গত বছরের শেষের দিকে চাকরিতে এসেছে সঞ্চয়িতা। চাকরিতে আসলে তেমন বাঁধাধরা কোন নিয়ম নেই। সে এবং আর একটি মেয়ে, মূলত পালাক্রমে মনিটর এর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সঞ্চয়িতার চাকরির সময় সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত।
মনিটর এর মধ্যে একটা বিশাল সবুজ মানচিত্র। আশেপাশের এরিয়াকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এর মধ্যে রাখা হচ্ছে, এতটুকুই যা ।কিন্তু কেন,কি কারণে এর উত্তর আজও অজানা সঞ্চয়িতার কাছে । তবে যাই হোক, মাস শেষে একটা ভালো পরিমান টাকা পাওয়া যায়, এটাই আসল কথা।
রাত ৪ টা ৩৩মিনিট।
অবশেষে পাক্কা ২ ঘণ্টা অনবরত গেম খেলার পর একটি কঠিন লেভেল শেষ করতে পারল। মনিটর এর দিকে তাকাল, কোন অস্বাভাবিক কিছু নেই। না থাকারই কথা।
যেই না নতুন লেভেল খেলতে যাবে, অমনি মনে পড়লো পেটে একটা দানাও পড়ে নাই সন্ধ্যা থেকে। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে একটা চকলেট বার্গার বানিয়ে নিলো নিজের জন্য। মনে পড়লো ছোট ভাই এর কথা, সবচেয়ে পছন্দের বার্গার তার। বেচারা গত 4 দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। এবার বন্ধে ওর জন্য নতুন গেম সেট এক্স-3 কিনে নিয়ে যাবে।
রাত ৫ টা ২১মিনিট।
গল্পের বইয়ে একদম বিভোর হয়ে ছিল সঞ্চয়িতা। কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই । ঠিক তখনই হঠাৎ করে পুরা রুমে লাল বাতি জ্বলে উঠল! আকস্মিক এই ঘটনায় সঞ্চয়িতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।এরকম কিছু তোহ কখনো হয়নি । লাল বাতি জ্বলার ৫ সেকেন্ড পরেই রুম এর উপরের স্পিকার থেকে এক বাজখাই আওয়াজে হুঙ্কার এলো!!
"সঞ্চয়িতা!!! কোথায় তুমি !!! তুমি যেখানেই থাকো এখনি মনিটরের সামনে যাও!!"
""এহহে ,বই পড়তে পড়তে স্ক্রীন এর দিকে তাকাতেই ভুলে গেলাম ।আজ হয়তো চাকরি শেষ।" ভাবতে ভাবতে মনিটর এর দিকে এগিয়ে গেলো। সব তোহ স্বাভাবিক । তাহলে কেন এতো চিল্লাচিল্লি! বাজখাই আউয়াজ এর মালিক হচ্ছে আর কেও নাহ ,স্বয়ং ক্যাপ্টেন নিজে। কিন্তু এতো ভয়ার্ত এবংউ দগ্রীব গলা কেন ছিল উনার ?
"ক্রিং ক্রিং"
"হ্যালো স্যার",সঞ্চয়িতা ইয়ারপিস কানে লাগিয়ে বলল ।
"কই থাকো তুমি! "বাজখাই হুঙ্কার ক্যাপ্টেন এর
"দুঃখিত স্যার। "
" মনিটর এর দিকে তাকাও। ১০৩°, C-২২ কিমি. এ চোখ দাও। "
জুম করে ,ওই নির্দিষ্ট স্থানে কার্সর নিয়ে গেলো সঞ্চয়িতা ।
"স্যার ,একটা লাল ডট এর মত । ওই জায়গার ক্যামেরা এক্টিভেট করবো ?"
"হ্যাঁ,দেখ তোহ কি ওটা"
"স্যার বুঝা যাচ্ছে না । তবে ছোটোখাটো একটা ড্রোন স্যার । কিন্তু এতো রাতে ড্রোন কে চালাবে এখানে!"
" শিট! শুনো ড্রোনটা হয়তো আমাদের দিকেই আসছে । কিবোর্ড এর নিচে দেখো একটা লাল বাটন আছে "ডিজেবল " লেখা । টার্গেট লক করে ক্লিক করবা, যদি দেখো এর গতিপথ আমাদের ৫০০ মিটার এর মধ্যে হয় । "
"আচ্ছা স্যার। "
এক অজানা আশংকা গ্রাস করলো সঞ্চয়িতাকে। কি এমন জিনিস যেটার জন্য স্বয়ং ক্যাপ্টেন এতো চিন্তিত হয়ে তার সাথে কথা বলছে! মনিটরএ চোখ গেলো আবার।ক্যাপ্টেন এর জায়গার অনেক কাছাকাছি ।২ কিলোমিটারের মতো । ঠিক ঐখানেই যাচ্ছে ।
১ কিলোমিটার এর কাছাকাছি
কিবোর্ডের কাছাকাছি গেলো সঞ্চয়িতা । কিন্তু যেতে না যেতেই
ধুম করে সবকিছু অন্ধকার । স্ক্রীন ,রুম এর বাতি ,এমনকি তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের ডিসপ্লেতেও আলো জ্বলছে না । নিকষ কালো অন্ধকারে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যাছে নাহ।
যেই নাহ অ্যালার্ম বাজাতে যাবে অমনি আবার সবকিছু সচল হয়ে গেলো । যেন কোনকিছু কখনোই ঘটে নেই । এই ঘটনাকে কোন সাধারণ সমস্যা ধরে পাত্তা দিলো না সঞ্চয়িতা । মনিটর এর দিকে চোখ যেতেই অবাক হয়ে গেলো । লাল ডট টি ৬০০ মিটারের মধ্যে। দ্রুত কিবোর্ড এর লাল বাটন এর দিকে হাত চলে গেলো ।
"হ্যালো সঞ্চয়িতা " বাজখাই captain এর কণ্ঠ
"স্যার ,বিদ্যুৎ চলে গেলো যে একটু আগে ? "
"ওটা কিছু নাহ . টার্গেট এর কি অবস্থা ?"
"জি স্যার , আমি টার্গেট লক করে রেখেছি । আর একটু আগালেই শুট করবো । "
" না ,থাক । আসতে দাও ,আমাদের এখানে। "
"কিন্তু স্যার?"
"আসতে দাও । টার্গেট লক করা লাগবে নাহ । "
"স্যার ড্রোনটা থেকে তোহ কোন প্রকার সিগন্যাল আসছে নাহ । এরকম ড্রোন তোহ আমাদের ডাটাবেইজ এ এন্ট্রি নেই । "
"আসতে দাও ,বললাম তোহ । "
"কিন্তু স্যা..." মাথা ঝিম করে উঠল সঞ্চয়িতার!
তোমার ভাই কেমন আছে ?"
"আছে স্যার ভালো । "
ড্রোন গন্তব্যের ১৫০ মিটার রেঞ্জএ।মাথা ঝিম ঝিম করছে সাংঘাতিক ।
"জ্বর কমতে কয়দিন লাগবে? "
"জানি না স্যার ,তবে ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত ।"
ড্রোন ১০০মিটারের কাছে । চোখ পর্যন্ত ব্যাথা করছে এখন ।
"গেম সেট ৩এক্স খুব পছন্দ তার,নাহ? "
ড্রোন ৫০ মিটারের মধ্যে।
বিদ্দুতগতিতে সঞ্চয়িতা কিবোর্ড এর লাল কী তে টিপ দিলো ।
"এটা করা উচিত হয়নি তোমার " একদম হিমশীতল কণ্ঠে ক্যাপ্টেন বলে উঠলো ।
মুহূর্তেই সঞ্চয়িতার মাথা ব্যাথা সম্পূর্ণ গায়েব । ধপ করে বসে পড়ল চেয়ার এ । এখনো এক অজানা আতঙ্ক কাজ করছে তার মধ্যে । স্পিকার এর ঐখানে যে কথা বলছিল সে আর যেই হোক তার ক্যাপ্টেন না । ভাই কে গেম সেট কিনে দেওয়ার কথা সঞ্চয়িতা নিজে ছাড়া আর কেও জানে না!
"হ্যালো !"ক্যাপ্টেন এর বাজখাই কণ্ঠ ।
"স্যার "
"তুমি ঠিক আছো ?পাওয়ার ব্রেকডাউন এর পর থেকে তোমার এখানে কোনো প্রকার যোগাযোগই করা যাচ্ছে নাহ । কোথায় ছিলা ? আর ওই ড্রোন এর কি অবস্থা ?"
সবকিছু খুলে বললো সঞ্চয়িতা তার ক্যাপ্টেনকে।
"বুঝেছি , আসলে তোমাকে প্রথমেই বলা উচিত ছিল । তুমি মনিটর এর যেই এরিয়ার দিকে ১২ ঘণ্টা নজরে রাখো, এখানে ১৯৯৭ সালে একটি ধমুকেতু উড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায় ,উল্কা পড়ার সময় সকলের তীব্র মাথা ব্যাথা হয়েছিলো । এমনকি ২০১২ সালে , একই ঘটনা ঘটে । তখন যে অপারেটর ছিল ,আমার স্যার,সে বলেছিল উনার মৃত মা উনাকে কল দিয়ে কথা বলে ।
এর কয়েকবছর পরে ,আমি এবং আমার স্যার একসাথে ছিলাম, বনের ওই নদীর তীরে ,ড্রোনের মতো দেখতে জিনিসটা আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে যায় । লাগছিল যে মাথা ছিঁড়ে যাবে ,এমন ব্যাথা।
তবে এটা যে আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে আমাদের স্মৃতি, আমাদের সকল কিছু জেনে যায় ,তার সন্দেহ নেই। তাদের প্রযুক্তি আমাদের থেকেও অনেক উন্নত। সম্পূর্ণ কমিউনিকেশন মুহূর্তে অচল করে দিলো । আর তোমার কথা যদি ঠিক হয় ,তবে আমাদের কণ্ঠ নকল করাও ওদের হাতের মুঠোয় এখন।
সবকিছু শুনছিল কেবল সঞ্চয়িতা । মনে মনে ভাবতে লাগলো নাহ এই চাকরি আর করবে নাহ সে। কি সব ভুতুড়ে এলিয়েনদের দিকে এতদিন নজর রাখছিল। আর নয় । কালকেই ছেড়ে দিবে এই কাজ।
"তুমি বরং এখন রেস্ট নাও, রশ্মিকে পাঠাই।" এটা বলে ক্যাপ্টেন কল কেটে দিলো ।
৬ টা ২২
"কি করছো ?"
আকস্মিক এই কণ্ঠে পিছনে তাকাল সঞ্চয়িতা, আর কেও নাহ , রশ্মি নিজে ।
"তুমি কখন এলে?"
"মাত্র "
"ওহ আচ্ছা!"
"তোমাকে এতো উদ্বিগ্ন লাগছে কেন ?"
"তা আর বলতে ,এই কাজ আমি কালই ছেড়ে দিবো । "
" কাল কেন, আজকেই হয়তো ছেড়ে দেওয়া লাগবে " অবিকল ক্যাপ্টেন এর বাজখাই কণ্ঠ্যে ভেসে এলো রশ্মির মুখ থেকে
মাথায় এবার এক তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করলো সঞ্চয়িতা । সবকিছু চোখের সামনে অন্ধকার হওয়ার আগে কেবল একটি কথাই মাথায় আসলো তার ,
মহাজাগতিক এসব প্রাণীদের কাছে মানুষ বড্ড অসহায়।